'আমাকে বাঁচতে দাও, মারা গেলে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থাকবে'
হরতালে অগ্নিদগ্ধ আরো দুই গাড়ি চালকের মৃত্যু
'ভাইরে আমাকে মেরো না, আমি না থাকলে ছেলেমেয়েরা না খেয়ে মারা যাবে'। গাড়ি চালকদের এমন আর্তনাদেও মন গলেনি পিকেটারদের। গান পাউডার দিয়ে পিকেটাররা আগুন ধরিয়ে দেয় গাড়িতে। জামায়াতের ৪৮ ঘন্টা হরতালে অগ্নিদগ্ধ সেই দুই চালক অবশেষে গতকাল সোমবার মারা গেলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে। এই নির্মমতার শিকার দুই চালক হলেন, সেকেন্দার বেপারী (৪২) ও নজরুল ইসলাম (৩৫)। এর আগে গত রবিবার ঢাকা মেডিক্যালে মারা যান ট্রাক চালক শামসুল হক সামসু (৫৫)।
জামায়াত শিবিরের হরতালে পেটের দায়ে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামা এসব চালক হরতালকারীদের কাছে তাদের জীবন রক্ষা করার অনুরোধ করলে পিকেটাররা জবাব দেয়, জানস না জামায়াতের হরতাল। একথা বলেই গান পাউডার দিয়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। চালকরা যাতে গাড়ি থেকে বের হতে না পারে সেজন্য দরজার সামনেই লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল পিকেটাররা। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গাড়িতে। তাদের সমস্ত দেহ অগ্নিদগ্ধ হয়ে যায়। আশপাশের বাসিন্দা, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করে তাদের স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে তাদের স্থানান্তর করা হয়।
হরতালের প্রথম দিন কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামে পিকেটাররা ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক সেকেন্দার বেপারীর (৪২) সমস্ত শরীর দগ্ধ হয়ে যায়। হরতালের দ্বিতীয় দিনে গাজীপুরে পিকেটাররা বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক নজরুল ইসলামের (৩৫) দেহ ঝলসে যায়। গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে তিন ঘন্টার ব্যবধানে ঐ দুই চালক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ময়না তদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে আত্মীয়-স্বজন উভয় চালকের লাশ গ্রহণ করেন। মারা যাওয়ার আগে দুই চালক স্ত্রী, সন্তান ও আপনজনদের কাছে বর্ণনা করে যান জামায়াত-শিবির কর্মীদের নির্মমতার কথা। জীবন বাঁচাতে তাদের শেষ চেষ্টার কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন স্ত্রী সন্তানরা।
জামায়াত-শিবিরের হরতালের দ্বিতীয় দিন গত বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুর ভোগড়া পাইবাস সড়কে পিকেটাররা একটি মিনিবাসের (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২৭৯২) গতিরোধ করে। ঐ সময় চালক নজরুল ইসলামকে পিকেটাররা গালিগালাজ করে বলে, তুই জানস না, জামায়াতের হরতাল। এ কথা বলে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। দরজা বন্ধ করে পিকেটাররা লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। ঐ সময় নজরুল পিকেটারদের অনুরোধ করে বলেন, ভাই আমাকে বাঁচান, আমি মারা গেলে আমার মেয়েরা না খেয়ে মারা যাবে। নজরুলের আর্তচিত্কার জামায়াত-শিবির কর্মীদের কাছে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি। গান পাউডার সংমিশ্রণে সৃষ্ট আগুনে পুরো মিনিবাস দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝলসে যায় তার শরীর। দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুলিশ। আসে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরাও। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
চালক নজরুলের বড় ভাই ফিরোজ বলেন, গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ঢাকা আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মিনিবাস চালাতো নজরুল। পিকেটারদের কাছে দুই হাত উঁচিয়ে বাঁচার আকুতি করেছিল আমার ভাই। নজরুলের বড় মেয়ের নাম নিগার (৭) ও ছোট মেয়ে মীম দেড় বছরের। সেদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় নজরুল দুই মেয়েকে আদর করেছিল। এটাই যে তাদের বাবার শেষ আদর তা তারা বুঝতে পারেনি।
গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, নজরুল হত্যাকাণ্ডে গাজীপুর সদর থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। নজরুলের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল থানার নোয়াখোলা গ্রামে।
হরতালের প্রথম দিন রাত ৯টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামে পিকেটাররা একটি ট্রাকের (চট্ট-মেট্রো-১১-১৬৫৯) পেট্রোল ও গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। চালক সেকেন্দার বেপারী বাঁচার জন্য পিকেটারদের কাছে আবেদন করেছিলেন। তার কোন কথাই না শুনে ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় পিকেটাররা। সেকেন্দারের সমস্ত দেহ ঝলসে যায়। তাকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে বিজয় (৪) ও কন্যা আয়েশা (১০)। তার গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার জাজিরা থানার উত্তর ক্যাবল গ্রামে। তিনি ঢাকা শ্যামপুর থেকে ট্রাকযোগে জেনারেটর নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন। কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামে গিয়ে পিকেটারদের হামলার শিকার হন।
কান্না জড়িত কণ্ঠে সেকেন্দারের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, তার আয়ের ওপর সংসার চলতো। এখন পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে থাকতে হবে। কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী বলেন, এ ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) সংবাদদাতা জানান, ট্রাক চালক সেকেন্দার হত্যার ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই রুহুল আমিন বাদী হয়ে উপজেলা জামায়াতের আমীর সাহাবউদ্দীন, সেক্রেটারি শাহ মো. মিজানুর রহমান ও পৌর আমির মাহফুজুর রহমানসহ ১০৪ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন।
এর আগে হরতালের প্রথম দিন বগুড়া শেরপুর থানার দশ মাইল নামক স্থানে পিকেটাররা ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দিলে চালক শামসুল হক সামসুর (৫৫) শরীর ঝলসে যায়। তিনি গত রবিবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে মারা যান।
গাজীপুরে জামায়াত-শিবিরকর্মীদের নাশকতা: মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন বাসচালক নজরুল
নাশকতায় দগ্ধ ডা. রকিবুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক
মেডিকেল করেসপন্ডেন্ট বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | ||
ঢাকা: হরতালের আগের রাতে দুর্বৃত্তদের নাশকতার শিকার ডা. রকিবুল আলম ডিউকের শারীরিক অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক। ইতিমধ্যেই তার চিকিৎসার জন্য নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। |
জামায়াত-শিবিরের আগুনে পুড়ে কাতরাচ্ছে ওরা
সুজন ঘোষ,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
চট্টগ্রাম: ''ও মা, ও মা, মা'রে...।" হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন জামাল উদ্দিন। শিবিরের ছোঁড়া ককটেলে তার ডান পায়ে সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। ব্যান্ডেজ দিয়েও পায়ের রক্ত ঝরা বন্ধ করা যাচ্ছিল না। অবিরত রক্তক্ষরণে লাল হয়ে উঠেছিল পরনের সাদা প্যান্টও, এমনকী হাসপাতালের সাদা বিছানাও। সকাল সোয়া ১১টা। ওই সময় নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে থাকার কথা ছিল জামালের। কিন্তু এর বদলে তার ঠাঁই হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। শিবিরের ককটেল নিক্ষেপে তার এ পরিণতি। ....... |
__._,_.___