আযাদ ও কাদের মোল্লার রায়ে ট্রাইব্যুনাল
নৃশংস অপরাধ ঘটায় জামায়াত আলবদর
৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, অপরাধ করলেও সংশ্লিষ্ট আইনে সংগঠনের বিচার করার সুযোগ নেই। গতকাল জাতীয় সংসদে ওই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধন করে এই সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে মহি উদ্দিন চৌধুরীর সানসেট অ্যাট মিডডে বই উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, শুধু ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের আলবদর বলা হতো; জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী প্রভৃতির সদস্যদের বলা হতো আলশামস, আর উর্দুভাষী বিহারিদের বলা হতো আল মুজাহিদ। পাকিস্তান সরকার ও সেনারা কয়েকটি সহযোগী বাহিনী গঠন করে, যেমন: রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি। এসব সহযোগী বাহিনীর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগের সদস্য, বাঙালি বুদ্ধিজীবী, নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তিদের পাকিস্তানি সেনাদের চিনিয়ে দেওয়া।
রায়ে আরও বলা হয়, ২০১০ সালের ১ জুলাই দি ইকোনমিস্ট-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের তৎকালীন নাম) অনেক ইসলামি দলের সমর্থন পেয়েছিল। তাদের মধ্যে একটি ছিল জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরে তাদের আলবদর নামে একটি পাকিস্তানি সেনাপন্থী আধাসামরিক বাহিনী ছিল।
রায়ের সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অংশে বলা হয়, একাত্তরে বাংলাদেশের আপামর মানুষ সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও সমর্থন করে। তবে কিছুসংখ্যক বাঙালি, বিহারি, পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বিশেষত জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ। তাদের সঙ্গে আরও ছিল মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামী ইসলামী। এসব দল সম্মিলিতভাবে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরোধিতা করে। এদের মধ্যে বেশির ভাগ দল বিভিন্ন নৃশংস কর্মকাণ্ড ঘটায় ও ঘটাতে সহযোগিতা করে, যা প্রচলিত আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার উষালগ্নে নৃশংসতার ভয়াবহতা রায়ের পরবর্তী অংশে উল্লেখ করা হয়। একটি প্রতিবেদনের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধকালে ঢাকায় এক রাতে ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। প্রতিদিন গড়ে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিত প্রায় ৩০ হাজার মানুষ।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালি পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের নিশ্চিহ্ন করতে এবং বাঙালি রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রদের হত্যা ও গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে 'অপারেশন সার্চলাইট'-এর নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। জামায়াতে ইসলামী আধাসামরিক বাহিনী বা সহযোগী বাহিনী গঠন করে নিরস্ত্র বাঙালি বেসামরিক ব্যক্তিদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযানে অংশ নেয়। ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ফক্স বাটারফিল্ড লেখেন, আলবদরকে জামায়াতের 'অ্যাকশন সেকশন' মনে করা হয়। একাত্তরের মার্চে ঢাকার পাকিস্তানিদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের জন্য তাদের সংগঠিত করা হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনাল পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী ও অন্য পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এমন স্বাধীনতাবিরোধী ও নৃশংস ভূমিকার পরও তাদের বিচার সম্ভব নয়। কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(১) ধারা অনুসারে 'সংগঠন'-এর বিচার করার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের নেই। আইন এখানে নীরব।
জামায়াতের সাবেক সদস্য (রুকন) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়েও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের নৃশংসতার কথা উল্লেখ করা হয়। আযাদকে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে গত ২১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেন। ওই রায়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অংশে মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তাতে বলা হয়, একাত্তরের ২৫ মার্চ 'অপারেশন সার্চলাইট' নামের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জামায়াত ও ছাত্রসংঘ এবং রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি সহযোগী বাহিনী। তারা সক্রিয়ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে এবং নৃশংস অপরাধ সংঘটন করে। জামায়াত আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে নিরস্ত্র বাঙালি বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে অভিযানে নামে।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল বা নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সনদের নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়, কোনো গোষ্ঠী বা সংগঠনের একজন সদস্যের বিচারের সময় ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা গোষ্ঠীকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে পারবেন। ১৯৪৫ সালের ২০ অক্টোবর নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ ২২ জন ব্যক্তি এবং সাতটি সংগঠন ও গোষ্ঠীর বিচার করে। সংগঠন ও গোষ্ঠীগুলো হলো: ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি (নাৎসি পার্টি), হিটলারের মন্ত্রিসভা (রাইখ ক্যাবিনেট), এসএস, এসডি ও এসএ (নাৎসি বাহিনীর অধীনে তিনটি আধাসামরিক বাহিনী), গেস্টাপো (গোপন পুলিশ বাহিনী) এবং জার্মান সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চতর নেতৃত্ব। বিচারে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় নাৎসি পার্টিসহ চারটি সংগঠন দোষী সাব্যস্ত হয়। নাৎসি পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
__._,_.___