শাহবাগ স্কয়ার :পরিবর্তনের আভাস -শুভ কিবরিয়া
চলমান রাজনীতিতে কোনো নতুন দিনের কথা নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হিংসা, হানাহানি, দ্বেষ, জিঘাংসা ছাড়া দেশভাবনার কোনো বড় জায়গা নেই। চারদিকে একের পর এক অনাচার ঘটছে, রাজনীতি তাকে পুঁজি করেই পুষ্ট হচ্ছে। ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তি সেই সুযোগ নিয়েছে। ১৯৭১-এ গণহত্যা আর বাংলাদেশ বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের সুবিধাবাদী রাজনীতির সুযোগ নিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়েছে। এবারও মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে ভোট নিয়ে এসে সেই ইস্যুকে নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। এমনকি জামায়াত-আওয়ামী লীগ আঁতাতের আওতায় বিচারের নামে প্রহসনের অভিযোগ উঠেছে। প্রচলিত রাজনীতির এই চলমান কুটিলতাকে পুঁজি করেই ক্ষমতার রাজনীতি পুরনো পথে হেঁটেই তার সাফল্যের কথা ভেবেছে। কিন্তু দেশের নতুন প্রজন্ম এই বেপথু রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে শাহবাগে নতুন জমায়েত তৈরি করে বার্তা দিয়েছে। তারা এই চলমান রাজনীতিতে পরিবর্তন চায়। প্রথাসিদ্ধ রাজনীতির দিন আর চলবে না। মানুষকে বোকা বানিয়ে, ভাঁওতা দিয়ে, মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে রাজনীতিবিদরা যা ইচ্ছে তাই করতে চাইলেও তা করতে দেয়া হবে না। অনামি তরুণদের নেতৃত্বে শাহবাগ স্কয়ারের লাখো জনতার জমায়েত সেই বার্তাই দিয়েছে দেশের জনগণকে।
২.
শাহবাগ স্কয়ারে জমায়েত হবার কারণ কি? কাদের মোল্লার রায় মানুষকে অসন্তুষ্ট করে তোলে। কেন?
প্রথমত, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার বিচারের রায়ে তাকে ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ৬টি। ১. মুক্তিযুদ্ধের সময় কাদের মোল্লার নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লবকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২. ২৭ মার্চ ১৯৭১ কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দুই ভাইকে মিরপুরের বাসায় গিয়ে হত্যা করে। ৩. ২৯ মার্চ ১৯৭১ সালে সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুরের পাম্পহাউসের জল্লাদখানায় কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীরা জবাই করে হত্যা করে। ৪. ২৫ নভেম্বর ১৯৭১ কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর ও ভাওয়াল খানবাড়ী এলাকায় কাদের মোল্লার নেতৃত্বে রাজাকাররা শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। ৫. ২৪ এপ্রিল ১৯৭১ মিরপুরের আলুব্দী গ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তায় কাদের মোল্লা তার সহযোগীদের নিয়ে ৩৪৪ জন মানুষকে হত্যা করে। ৬. ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে মিরপুরের কালাপানি লেনের অধিবাসী হযরত আলী এবং তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্যকে ধর্ষণ ও হত্যা করে কাদের মোল্লা।
এই ছয়টি অভিযোগের বিরুদ্ধে আদালত ১, ২, ৩ নম্বর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ১৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ এবং ৬ নম্বর অভিযোগের প্রেক্ষিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় এবং ৪ নম্বর অভিযোগের প্রেক্ষিতে কাদের মোল্লাকে বেকসুর খালাস দেয়।
দ্বিতীয়ত, এই রায়ে দেখা যায়, গণহত্যার অভিযোগে কাদের মোল্লা বেকসুর খালাস পায়। যেসব অভিযোগে কাদের মোল্লা যাবজ্জীবন এবং ১৫ বছরের কারাদণ্ড পায় সেরকম অভিযোগের প্রেক্ষিতে এর আগে বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসি দেয়া হয়।
কাদের মোল্লা ও বাচ্চু রাজাকারের রায় পর্যালোচনায় নিলে সাদা চোখে সন্দেহ জাগে কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
তৃতীয়ত, কাদের মোল্লা জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা। এই রায় হবার আগে রাজপথে সরকারি সহায়তা পায় জামায়াত-শিবির। হরতাল, সহিংসতা করে তারা। পুলিশ এবং শিবির কর্মীদের সহাবস্থান সবার নজর কাড়ে।
হঠাৎ করে জামায়াত-শিবির এবং পুলিশের সুসম্পর্ক, জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা বিষয়ে সরকারের নমনীয়তা জনমনে সন্দেহ তৈরি করে। মানুষ কাদের মোল্লার নমনীয় রায়ের সঙ্গে সরকার-জামায়াতে ইসলামীর গোপন আঁতাতের গন্ধ খুঁজে পায়।
সরকারের বিরুদ্ধে এক ধরনের ক্ষুব্ধতা তৈরি হয়। এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ একদল অনলাইন ব্লগার ও একটিভিটিস্ট এবং বাম সংগঠনের নেতাকর্মীরা শাহবাগ স্কয়ারে এক স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত গড়ে তোলে। পরবর্তীতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে তা এক নয়া জাগরণের চেহারা পায়। দেশ ও বিদেশের মিডিয়ায় তা ব্যাপক প্রচার পায়।
৩.
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই নয়া জাগরণের মধ্য থেকে কি বার্তা আসছে?
প্রথমত, এই নয়া জাগরণের নেতৃত্বে নেই পুরনো মুখ। সম্পূর্ণ অখ্যাত, অচেনা একদল তরুণ প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক নেতাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাদের প্রাণের দাবি তুলেছে।
যে প্রচলিত রাজনীতি, রাজনীতিবিদরা ভোট আর ক্ষমতার লোভে নানারকম অপকর্ম, আঁতাত করে সমাজে নিজেদের পরিচিতি বাড়িয়েছে তাদের প্রত্যাখ্যান করেই এই গণজাগরণ শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, শাসকশ্রেণী কিংবা ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদরা সবসময় যে ভাবেন, তাদের ছাড়া বিকল্প নেই, সেই একঘেয়েমি ভাবনাকে এই জাগরণ মিথ্যা প্রমাণ করেছে।
বড় দুই দল আওয়ামী লীগ, বিএনপির বড় নেতাদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছাড়াই নতুন প্রজন্মের এই সম্মিলিত জাগরণ প্রমাণ করেছে প্রয়োজনে, দেশের স্বার্থে নতুন প্রজন্ম প্রচলিত রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে নয়া ধারার রাজনীতির সূত্রপাত করার সক্ষমতা রাখে।
তৃতীয়ত, পাঁচ-ছয় দিন ধরে দেশের কেন্দ্রস্থল দখল করে ছাত্রজনতার এই প্রতিরোধের শক্তি এতই প্রবল, এখানে বড় দুই দলের দুই নেত্রীর কোনো বাণী নেই, উপস্থিতি নেই। সেটা পৌঁছনোর কোনো সাহস নেই। কেননা, দুই বড় দলের দুই নেত্রীর যে কোনো কথা বা বাণী এখানে প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনা ছিল।
চতুর্থত, এই জাগরণের ভবিষ্যৎ যাই হোক না কেন, একটি দাবি খুব সুস্পষ্ট। স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীদের বিচারের ইস্যুকে এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। এই জাগরণ সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে যে কোনো আপসরফার চেষ্টা হলে, রাজনৈতিক ফায়দা লাভের গোপন আঁতাত হলে তারা তা মানবে না।
পঞ্চমত, গণজাগরণের বড় সুর ছিল স্বতঃস্ফূর্ততা। শৃঙ্খলা। লাখো মানুষ সমবেত হয়েছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ- নানান বয়সী মানুষ এখানে এসেছেন। নারীরা রাত-দিন থেকেছেন। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা আর শৃঙ্খলার নিদর্শন ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রয়োজনে মানুষ যে শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা আর স্বতঃস্ফূর্ততা দিয়ে জেগে উঠতে পারে এই শাহবাগের গণজাগরণ তার বড় প্রমাণ।
ষষ্ঠত, এই গণজাগরণের একটা বড় মাধ্যম ছিল মিডিয়া এবং নয়া মিডিয়া। ব্লগ, ইন্টারনেট, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার মতামত বিনিময়ে পারস্পরিক যোগাযোগে যে নতুন ভূমিকা আনছে তার প্রমাণ রেখেছে শাহবাগের জাগরণ। আমাদের রাজনীতিবিদরা এই নয়া মিডিয়ার শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞ। রাজপথের রাজনীতিতে এই নয়া মিডিয়া যে বড় বড় সহায়ক হয়ে উঠতে পারে তার বড় প্রমাণ এই ঘটনা। আগামী দিনের রাজনীতিতে পরিবর্তনের সূচনা আনতে নয়া মিডিয়া বড় ভূমিকা রাখতে পারে তার দৃষ্টান্ত রাখল এই জাগরণ। পুরনো ধারণার, সেকেলে চিন্তার রাজনীতির জন্য এই নয়া মিডিয়ার রাজনীতি বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ সম্পর্কে আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি সচেতন না হন, তবে পদে পদে তারা হোঁচট খাবেন।
সপ্তমত, সরকার সবসময় মানুষের জাগরণকে ভয় পায়। সরকারের সংস্থাগুলো ব্যস্ত থাকে যাতে বড় জমায়েত না হয়। সরকারের যে কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষুব্ধতা যেন বড় জমায়েতের রূপ না নেয় সরকার ও তার বাহিনী, এজেন্সি সর্বদা তা প্রতিরোধের ব্যবস্থায় সচেষ্ট থাকে। কিন্তু জনগণের শক্তি যে অপ্রতিরোধ্য, মানুষের মনে যা আছে, মানুষ যা চায় তা না হলে, মানুষকে যে দাবিয়ে রাখা যায় না এ জাগরণ তার বড় প্রমাণ।
অষ্টমত, বাংলাদেশের জনমানস বৈশ্বিক ভাবনা দ্বারা প্রতিনিয়ত তাড়িত হচ্ছে। তাদের মনোভাবনায় পৃথিবীর ভালো আকাক্সক্ষাগুলো ছাপ ফেলছে। বিশেষত নতুন প্রজন্ম যে বৈশ্বিক নাগরিক হয়ে উঠছে এ ঘটনা তার প্রমাণ। আরব বসন্তে আরব তরুণরা যে স্বৈরশাসনবিরোধী বিপ্লব ঘটিয়েছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মনে তা ছাপ ফেলেছে। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক, ভালো অর্থনীতির দেশের মতো একটি কল্যাণকামী, গণতান্ত্রিক, উদার রাষ্ট্র প্রত্যাশা করে। তারা চায় দেশ চলুক রাষ্ট্রনৈতিক নিয়মে। দলবাজি, টেন্ডারবাজি, ভোটচুরির অগণতান্ত্রিক পন্থা চিরবিদায় নিক। আমাদের রাজনীতিবিদরা ছোটখাটো বিবাদে জড়িয়ে হরতাল-সহিংসতায় সম্পৃক্ত থেকে মানুষের স্বপ্নকে বিঘিœত না করুক। এই গণজাগরণ সে বার্তাও দিয়েছে।
৪.
বাংলাদেশের জনসংখ্যায় এখন সংখ্যাধিক্য হচ্ছে তরুণদের। বৈশ্বিক ভাবনায় বেড়ে ওঠা তরুণরা প্রযুক্তি চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক হচ্ছে, যৌক্তিক ভাবনা নিয়ে বড় হচ্ছে। এদের কাছে হিসাবগুলো খুব স্বচ্ছ। অপরাধ হলে তার সাজা হতে হবে। তারা রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে চায় না। তারা চায় দেশ এগিয়ে যাক। হরতাল, অবরোধ, রাজনৈতিক সহিংসতা তাদের জীবনকে আটকে না দিক। বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে তারা গোটা বিশ্বে তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিতে চায়। তারা চায় রাষ্ট্র ন্যায়ানুগ হয়ে তাদের পাশে দাঁড়াক। প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব হোক জনসেবকের। রাজনীতিবিদরা জনগণের মনের ভাষা পড়–ক। রাজনীতি ব্যবসা হয়ে জনগণকে শোষণ করুক- এই পুরনো ধারণা তারা বদলে দিতে চায়। শাহবাগের গণজাগরণ তাই প্রচলিত রাজনীতির জন্য এক বড় সতর্ক সঙ্কেত। যারা শাহবাগের গণজাগরণ দেখে নীরব আছে কিংবা সরবে বগল বাজাচ্ছে দু'পক্ষের জন্যই এই পরিবর্তনের বার্তা বোঝাটা খুব জরুরি।
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=7802
__._,_.___