বঙ্গবন্ধুর ছবি বাঘা সিদ্দিকীর টুপি ও ব্লগে কাদা ছোড়াছুড়ি
21 Feb, 2013
শাহবাগ একাত্তরের রণাঙ্গনের 'জয় বাংলা' সারা দেশে ছড়িয়েছে। জাতির বীরত্বের শিহরণ জাগানো এই স্লোগানে বঙ্গবন্ধু তার জনগণকে এক সুতায় বেঁধেছিলেন। গণজোয়ারে জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান নেই কেন? জাতির জনকের ছবি কেন শোভা পাচ্ছে না গণজাগরণ মঞ্চে? শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আশপাশের চেনা যে ক'টি চেহারা টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে তাদের কাছে এই প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পাইনি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি যেমন লাখো শহীদের মায়েদের প্রতীক হয়ে শাহবাগের গণজোয়ারে শোভা পাচ্ছে, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হয়ে ইতিহাসের ক্যানভাস আর মানুষের হৃদয়ে শোভা পাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
১৬ দিন অতিবাহিত হলেও শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে ঘিরে থাকা নানা পথের সুযোগ সন্ধানীরা আওয়ামী লীগের কাঁধে সওয়ার হয়ে থাকলেও একবারও এই তরুণদের বলেননি এই খানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানিয়ে দিতে। মুক্তিযুদ্ধের নামে যদি একটি ছবি শোভা পায় সেটি হবে শেখ মুজিবের ছবি। ইতোমধ্যে ব্লগার রাজীবের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও শান্তর হৃদরোগে করুণ মৃত্যু দেশবাসীকে ব্যথিত করেছে। উদ্বিগ্ন করেছে। মাঝখানে ব্লগারদের কাদা ছোড়াছুড়ি বা সাইবার যুদ্ধের নোংরা খেলা পরস্পরকে ঘায়েল করতে না পারলেও ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। দেশবাসীকে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করেছে। এই কাদা ছোড়াছুড়ির ইতি এখনই টানা উচিত। এমনকি শাহবাগের এই প্রজন্মের আন্দোলনেরও সীমারেখা টানার সময় এসেছে। ১৬ দিনে তাদের দাবি-দাওয়া সরকার, প্রশাসন, দেশবাসী জেনেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল তারুণ্যের সঙ্গে গণমানুষের কণ্ঠ শুনেছেন। সরকার ও ট্রাইব্যুনালের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। শাহবাগের নির্দেশে যদি স্কুলে স্কুলে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের আয়োজন করা হয় তাহলে শিক্ষামন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার দরকারটা কোথায়? স্কুলে স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে রোজ সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে জাতীয় সংগীত পরিবেশন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে শুরু হয়েছে। কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
মানুষের জানমালের হেফাজতের দায়িত্ব সরকারের। সরকার যেখানে শাহবাগের সব দাবির সঙ্গে একমত সেখানে যুদ্ধাপরাধের ফাঁসির দাবি ছাড়া জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধসহ অন্য দাবিগুলো সরকার মেজরিটির জোরে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে নিলেই পারে। তবে সরকার জানে তারা দেশবাসীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য মাথায় নিয়েই সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হবে কিনা এটি দেখার দায় ট্রাইব্যুনালের, সরকারের নয়। শাহবাগের গণজাগরণের কথা মাথায় নিয়েই ট্রাইব্যুনালকেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের ওপর মানুষের অগাধ আস্থা রয়েছে। বিচারকের কাছে আইন বড়, আবেগ নয়। ২. এদিকে সাইবারের এই কাদা ছোড়াছুড়িতে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের প্রতীক, বিশ্ব যাকে চিনেছিল টাইগার সিদ্দিকী বলে, সেই কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো স্ট্যাটাস দেওয়ার আগে মনে রাখতে হবে এই বেসামরিক যোদ্ধা বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন জান বাজি রেখে।
যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর জাতির জনকের চরণে কি সুশৃঙ্খলভাবে তার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। এ ধরনের একজন বীরের ভাস্কর্য বাংলাদেশের রাজধানীতে থাকার কথা ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধীকারিত্ব বহন করা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের পথের সাথী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্পষ্টভাষী অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেনা শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনিও ছিলেন একজন কর্মী। ছাত্রজীবনে কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ছিল কিনা আমার জানা নেই। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্যও নেই। তার কলাম ও টকশোর বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত গভীরভাবে। এতে আর যাই হোক আসিফ নজরুল কোনো শাসকের আজ্ঞাবহ দাস না হলেও, তিনি যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিপরীত মেরুতে এবং অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে পথ চলা এক অসাম্প্রদায়িক মানুষ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
৩. মঙ্গলবার সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বাংলাদেশ প্রতিদিনে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের কলাম পড়তে গিয়ে মনটা বিষাদে ভরে গেল। সিলেটের জেলা প্রশাসন সার্কিট হাউসে এই জনযুদ্ধের বীর পুরুষকে জায়গা দেয়নি। সরকারি সার্কিট হাউসে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের কত অযোগ্য আজ্ঞাবহরাও জামাই আদরে থাকার জায়গা পান। সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতারা চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। সেখানে তাদের সঙ্গে কথা বলে চিন্তা করেছিলাম ফিরে এসে লিখব। মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের ভিভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের সব পথে বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।
দেশে এখন অনেক মন্ত্রী-এমপি আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। এমনকি অতীতে সব সরকারেই স্বাধীনতাবিরোধীদের কখনো বা ঘাতকের গাড়িতে উড়েছে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা। এই স্বাধীন ভূমি এনে দিয়েছিলেন বীর যোদ্ধারা। তাদের একজন কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের প্রতি সার্কিট হাউসে না তুলে প্রশাসনের যে কর্মকর্তা অনাদর-অবহেলা দেখালেন তার প্রতিবাদ শাহবাগের গণজাগরণ থেকে ওঠা উচিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা পরাজিত হলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী গাদ্দার বলে, হিন্দুস্তানের দালাল বলে কাদের সিদ্দিকীর ফাঁসি দিত। সেদিনের আলবদর রাজাকাররা তার দিকে জুতা ছুড়ে মারত। আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবকে উন্মত্ত হাসিতে জল্লাদ ইয়াহিয়া ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে সেখানে কবর দিত। লাশখানিও তার মাতৃভূমিতে পাঠাত না। কাদের সিদ্দিকীর সব মতামত ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি একমত নই। আমার সবকিছুর সঙ্গেও কেউ একমত হয় না। এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের নমুনা। কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর আসন আমার হৃদয়ে এখনো গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে রেখেছি। শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে, বিশ্বাসঘাতকতা করলে তিনি অনেক আগেই মন্ত্রী হতে পারতেন। তিনি হননি।
পেশার তারে জড়ানো জীবনে বহু আগে তার বাবর রোডের বাড়িতে এক রাতে তার সঙ্গে খেয়েছিলাম। আলু ভর্তা, ছোট মাছ ও ডাল ছিল। অতি সাধারণ খাবার খেয়ে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। মুজিব হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যাওয়া কাদের সিদ্দিকীর প্রতি এই ভেবে মনে মনে আরেকবার শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম যে, জাতির জনকের হত্যার পর থেকে তিনি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর কলামে একাত্তরে অবরুদ্ধ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সন্তানসম্ভবা হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে তার লেখা অংশটুকু আমার রুচিতে লেগেছে পাঠক হিসেবে। একজন লেখক লেখেন তার স্বাধীনতায়। গ্রহণ করা না করা পাঠকের ব্যাপার। আমি তা গ্রহণ করিনি। কিন্তু তিনি শাহবাগের জানাজা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন একজন মুমিন মুসলমানের সন্তান হিসেবেই হোক আর আল্লাহভীরু ও রাসূলের অনুসারী হওয়ার কারণেই হোক তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত। জানাজা নামাজ ধর্মীয় ব্যাপার। এটা ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে ধর্মীয় নির্দেশিত পথেই আদায় করতে হয়। একজন মুসলমানের জন্য গোসল করার পরও নামাজের আগে অজু বাধ্যতামূলক।
শাহবাগে রাজীবের কফিন নিয়ে যদি শুধু প্রতিবাদ মিছিল হতো তাহলে কাদের সিদ্দিকী প্রশ্ন তুলতেন না। তুললে আমিও তার সঙ্গে একমত হতাম না। কিন্তু একজন মুসলমানের এই মৃত্যু শহীদি হলেও তার জানাজার দৃশ্য অনেককেই ব্যথিত করেছে। কাদের সিদ্দিকী সাহসী মানুষ বলে লিখেছেন। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ব্যথিত হয়েছেন। আল্লাহভীরু ধর্মপ্রাণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লাখো লাখো রাজনৈতিক কর্মী বিতর্ক এড়াতে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেননি। যারা আস্তিক তারা জানাজা নামাজে পবিত্র হয়েই গেছেন। নাস্তিকরা দূরে থাকলেই পারতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানই নন, তিনি তা গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে তার স্বাধীন ভূমিতে ফিরে এসে অশ্রুসজল নয়নে দেওয়া বক্তৃতায় পরিষ্কার বলেছেন, 'আমি মুসলমান। মুসলমান বার বার মরে না, একবার মরে'। মওলানা ভাসানীর মতো প্রগতিশীল জনপ্রিয় বাম নেতার আগমন ঘটেনি এই মাটিতে। নামাজ ও ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকা মানুষটি মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে সমান নাগরিক অধিকারে বসবাস করার চেতনাই অসাম্প্রদায়িকতা। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে বুঝি রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে না আনা।
সব ধর্মের মানুষের আত্দীয়তার বন্ধনে বাস করা। কাদের সিদ্দিকীর কলাম পড়ে সিলেটের যুগান্তরের ব্যুরো চিফ রেজওয়ান আহমেদের কাছ থেকে জেলা প্রশাসকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করলাম। ফোন করে নিজের পরিচয় দিতেই দেখলাম তিনি আমার প্রতিবেশী, পূর্ব পরিচিত। এক সময় ভোরের হাঁটাহাঁটিতে দেখা হতো। খান মোহাম্মদ বেলাল এখন সিলেটের ডিসি। একজন সজ্জন মানুষ। অমায়িক তার ব্যবহার। কাদের সিদ্দিকীর বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানালেন, এডিসি জেনারেল এটি পুরো জানেন। তবে যতটা বুঝলাম উপর মহলের ভয়ে কাদের সিদ্দিকীর বিষয়টি তারা এড়িয়ে গেছেন। উপরের নির্দেশ ছিল কিনা জানি না। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপের খানিক পরই একটা টেলিফোন এলো। পরিচিত কণ্ঠ। এনামুল হাবিব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অনুজ ছিলেন। ভদ্র, বিনয়ী, মেধাবী এনামুলের ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। বাবা প্রফেসর হাবিবুর রহমান সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে সিলেটের হজরত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর হাবিবুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ নির্লোভ, নীতিবান এক আদর্শ মানুষ ছিলেন।
প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার এই মানুষটির সন্তান এনামুল হাবিব আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। কিন্তু এনামুল হাবিব যখন কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন তখন আমার মনে খুব লেগেছে। লেগেছে মানে আঘাত লেগেছে। এনামুল হাবিব বললেন, কাদের সিদ্দিকী সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন, যা তারা দিতে পারেন না। আমি জানতে চাইলাম তিনি থাকতে চেয়েছিলেন কিনা? এনামুল বললেন, থাকা ও সংবাদ সম্মেলন দুটো চেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে বললেন, কাদের সিদ্দিকীর বর্তমান অবস্থান ও কথাবার্তা সব মিলিয়েই তিনি দিতে পারেন না। আমি বললাম, কত অখ্যাতজন, কত রাজাকার এ দেশে মন্ত্রী-এমপি হয়ে সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে বিদায় হওয়ার আগে প্রেস ব্রিফিং করেন। কর্মী সভা করেন। তাকে বললাম কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম একাত্তর ও পঁচাত্তর ঘিরে যে ভূমিকা রেখেছেন শুধু তার জন্যই রাষ্ট্রীয় সব মেহমানখানা খুলে দেওয়া উচিত। এনামুল হাবিব বলে বসলেন, একাত্তর ও পঁচাত্তরের কাদের সিদ্দিকীকে তিনিও শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু পরবর্তী কাদের সিদ্দিকীকে শ্রদ্ধা করার নাকি কিছুই নেই। পরের কাদের সিদ্দিকী নাকি শুধু অন্ধকার। ফোনটা রেখে দিয়ে বুঝলাম আমার ভেতরে অস্থিরতা।
আমি কেমন করে স্নেহভাজন এনামুল হাবিবকে জড়িয়ে লিখব। এত ঘনিষ্ঠতার এত হৃদ্যতা তার শেষ কথায় সম্পর্কের বিচ্ছেদের চুক্তিনামায় যেন সই করাচ্ছে আজ। কাদের সিদ্দিকী অপমানের প্রতিবাদে যখন সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তার আগে আমাকে এলাকায় নিয়েছিলেন। তিনি তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে মা-হারা সন্তানের মতো দীর্ঘক্ষণ শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। তার জনতা সঙ্গে কেঁদেছিল। কাদের সিদ্দিকী তার দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পদত্যাগ করে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। সেদিন এই বীরের গণরায় ঠেকাতে গোটা সরকার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও কাদের সিদ্দিকীর সম্পর্ক ভাই-বোনের। ভাই-বোনের সম্পর্ক বা ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক একবার ছিন্ন হলে যা দাঁড়ায় এখানে তা দাঁড়িয়েছিল বলেই কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রথম সম্মেলন শাসক দলের কর্মীরা গুলিবর্ষণের মুখে পণ্ড করেছিল। তবু কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্ব নেননি। নিজের শক্তিতে লড়ে জয়ী হয়েছিলেন। একুশের গ্রেনেড হামলার পর ভারত থেকে ফিরেই সোজা যান সুধাসদনে তার বড় বোনকে দেখতে। আজকের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বিএনপি নেত্রীর গলায় গামছা পরিয়ে দিয়ে ঐক্যের শর্ত দিয়েছিলেন।
যার অন্যতম জাতির শোকাবহ ১৫ আগস্টের রাতে জন্মদিনের কেক কাটা উৎসব না করা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি বন্ধ করা, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা। তবু একা ছুটে চলার পরও এনামুল বলছেন কাদের সিদ্দিকীর সময় অন্ধকার! তরুণ প্রজন্ম, ব্লগার, স্লোগানকন্যারা সেদিন জন্ম নেননি। তারা জানেন না কীভাবে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকী জাতীয় মুক্তিবাহিনীর নামে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করা মুজিব-অন্তপ্রাণ প্রায় আট হাজার তরুণকে নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন খেয়ে না খেয়ে। ১১৭ জন সেই যুদ্ধে শহীদ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় যে ইতিহাসকে অস্বীকার করা। সত্যকে আড়াল করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় জাতীয় বীরদের অনাদর-অবহেলা আর অপমানে তাদের জীবনকে অন্তহীন বেদনায় দগ্ধ করে জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও লাখো শহীদের আত্দাকে কষ্ট দেওয়া। দিগন্ত টেলিভিশনে যাওয়া যদি পাপ হয় তাহলে আসিফ নজরুল তো সেখানে কখনো যাননি? আর কাদের সিদ্দিকী ছাড়া সরকারের অনুগত বা আস্থাভাজন কারা এ পর্যন্ত গেছেন তাদের তালিকা বের করুন। বিএনপি জমানায় লাইসেন্স পাওয়া টিভি চ্যানেলগুলোকে সেদিন নিউজ কভার করার অনুমতি দিতেন না বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা।
ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী সেসব টিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রচার হতে দেখা গেছে। তার পরও শাহবাগের গণজাগরণ থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়ে আবেগ দিয়ে যদি তারুণ্য প্রস্তাব দিত দিগন্ত টিভিতে না যাওয়ার, নিশ্চয়ই তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না তার সন্তানদের। শহীদজননী জাহানারা ইমাম টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলেন বলেই নন্দিত লেখক, শহীদের পুত্র মরহুম হুমায়ূন আহমেদ ইনকিলাবে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার প্রিয় মানুষ নির্বাচন কমিশনের সচিব কবি মোহম্মদ সাদিক। মাথায় হ্যাট, পরনে ফিদেল কাস্ত্রোর মতো পোশাক, রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা বীরযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীর বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দেওয়ার যে দৃশ্য কলেজপড়ুয়া সাদিকের মনে দাগ কেটেছিল তা নিয়ে '৯৪ সালে লেখা কবিতা 'কাদের সিদ্দিকীর টুপি'-তে প্রকাশ পায়। সংবাদে সেটি প্রথম প্রকাশ হয়। পরে এই নামে '৯৭ সালে তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়। সিলেট সার্কিট হাউসের ঘটনায় সেই কাব্যগ্রন্থের কথা বার বার মনে পড়ছে। দলকানা আমলার হৃদয় আর কবির হৃদয়ে কত পার্থক্য। আমলারা হন ক্ষমতার দাস। কবিরা হন সুফি-সাধক। কবির হৃদয়ে মানুষ বাস করেন বলেই সেখানে বীরত্বের প্রতীক হয়ে শোভা পান কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম।
আমলার দরজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় জাতীয় বীরের! শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে আশপাশে এমন কাউকে কাউকে দেখা যায় যারা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ বীরউত্তমদের দেখেন না, কাদের সিদ্দিকীর উচ্চতা দেখবেন কীভাবে? এখানে এক চোখে দেখলে হবে না। এখানে শাহবাগের জনসে াতে যেমন মানুষ যায় তেমনি আরাফাতের ময়দানে ধর্মপ্রাণ মুসলি্লদের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক মিছিলে শরিক হয়। এখানে উৎসবমুখর দুর্গাপূজা হয়। পয়লা বৈশাখের রমনা বটমূলে নামে লাখো মানুষের জোয়ার। আবার তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমায় কিংবা জুমার নামাজে হজরত শাহজালালের মাজারের মসজিদে মুসলি্লদের ঢেউ খেলে যায়। এসব মিলিয়েই এক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সবটাই আজ দেখতে হবে। দেখতে হবে একটি জাতি কীভাবে বিভক্ত রাজনীতির মাঝখানে মিরপুর জাতীয় স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপ ক্রিকেট ফাইনালে বাংলাদেশ হয়ে যায়। তাই উগ্রতা নয়। কোনো বিভেদ নয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়। সাইবার যুদ্ধে কারও চরিত্রহনন নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে যুক্তিতর্ক, বিতর্ক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাই শেষ কথা।
১৬ দিন অতিবাহিত হলেও শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে ঘিরে থাকা নানা পথের সুযোগ সন্ধানীরা আওয়ামী লীগের কাঁধে সওয়ার হয়ে থাকলেও একবারও এই তরুণদের বলেননি এই খানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানিয়ে দিতে। মুক্তিযুদ্ধের নামে যদি একটি ছবি শোভা পায় সেটি হবে শেখ মুজিবের ছবি। ইতোমধ্যে ব্লগার রাজীবের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও শান্তর হৃদরোগে করুণ মৃত্যু দেশবাসীকে ব্যথিত করেছে। উদ্বিগ্ন করেছে। মাঝখানে ব্লগারদের কাদা ছোড়াছুড়ি বা সাইবার যুদ্ধের নোংরা খেলা পরস্পরকে ঘায়েল করতে না পারলেও ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। দেশবাসীকে ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করেছে। এই কাদা ছোড়াছুড়ির ইতি এখনই টানা উচিত। এমনকি শাহবাগের এই প্রজন্মের আন্দোলনেরও সীমারেখা টানার সময় এসেছে। ১৬ দিনে তাদের দাবি-দাওয়া সরকার, প্রশাসন, দেশবাসী জেনেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল তারুণ্যের সঙ্গে গণমানুষের কণ্ঠ শুনেছেন। সরকার ও ট্রাইব্যুনালের প্রতি মানুষের আস্থা আছে। শাহবাগের নির্দেশে যদি স্কুলে স্কুলে জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীতের আয়োজন করা হয় তাহলে শিক্ষামন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার দরকারটা কোথায়? স্কুলে স্কুলে ক্লাস শুরুর আগে রোজ সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে জাতীয় সংগীত পরিবেশন মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর থেকে শুরু হয়েছে। কোথাও এর ব্যত্যয় ঘটলে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।
মানুষের জানমালের হেফাজতের দায়িত্ব সরকারের। সরকার যেখানে শাহবাগের সব দাবির সঙ্গে একমত সেখানে যুদ্ধাপরাধের ফাঁসির দাবি ছাড়া জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধসহ অন্য দাবিগুলো সরকার মেজরিটির জোরে প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে নিলেই পারে। তবে সরকার জানে তারা দেশবাসীর প্রতিনিধিত্ব করে। এই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জাতীয় ঐক্য মাথায় নিয়েই সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি হবে কিনা এটি দেখার দায় ট্রাইব্যুনালের, সরকারের নয়। শাহবাগের গণজাগরণের কথা মাথায় নিয়েই ট্রাইব্যুনালকেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ট্রাইব্যুনালের ওপর মানুষের অগাধ আস্থা রয়েছে। বিচারকের কাছে আইন বড়, আবেগ নয়। ২. এদিকে সাইবারের এই কাদা ছোড়াছুড়িতে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের প্রতীক, বিশ্ব যাকে চিনেছিল টাইগার সিদ্দিকী বলে, সেই কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো স্ট্যাটাস দেওয়ার আগে মনে রাখতে হবে এই বেসামরিক যোদ্ধা বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে থেকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন জান বাজি রেখে।
যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর জাতির জনকের চরণে কি সুশৃঙ্খলভাবে তার বাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। এ ধরনের একজন বীরের ভাস্কর্য বাংলাদেশের রাজধানীতে থাকার কথা ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধীকারিত্ব বহন করা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের পথের সাথী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্পষ্টভাষী অধ্যাপক আসিফ নজরুলকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেনা শাসনবিরোধী আন্দোলনে তিনিও ছিলেন একজন কর্মী। ছাত্রজীবনে কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রতি তার দায়বদ্ধতা ছিল কিনা আমার জানা নেই। তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্যও নেই। তার কলাম ও টকশোর বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত গভীরভাবে। এতে আর যাই হোক আসিফ নজরুল কোনো শাসকের আজ্ঞাবহ দাস না হলেও, তিনি যে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিপরীত মেরুতে এবং অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলে পথ চলা এক অসাম্প্রদায়িক মানুষ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
৩. মঙ্গলবার সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার পথে বাংলাদেশ প্রতিদিনে কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের কলাম পড়তে গিয়ে মনটা বিষাদে ভরে গেল। সিলেটের জেলা প্রশাসন সার্কিট হাউসে এই জনযুদ্ধের বীর পুরুষকে জায়গা দেয়নি। সরকারি সার্কিট হাউসে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের কত অযোগ্য আজ্ঞাবহরাও জামাই আদরে থাকার জায়গা পান। সুনামগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নেতারা চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। সেখানে তাদের সঙ্গে কথা বলে চিন্তা করেছিলাম ফিরে এসে লিখব। মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের ভিভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের সব পথে বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।
দেশে এখন অনেক মন্ত্রী-এমপি আছেন যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি। এমনকি অতীতে সব সরকারেই স্বাধীনতাবিরোধীদের কখনো বা ঘাতকের গাড়িতে উড়েছে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা। এই স্বাধীন ভূমি এনে দিয়েছিলেন বীর যোদ্ধারা। তাদের একজন কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের প্রতি সার্কিট হাউসে না তুলে প্রশাসনের যে কর্মকর্তা অনাদর-অবহেলা দেখালেন তার প্রতিবাদ শাহবাগের গণজাগরণ থেকে ওঠা উচিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা পরাজিত হলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী গাদ্দার বলে, হিন্দুস্তানের দালাল বলে কাদের সিদ্দিকীর ফাঁসি দিত। সেদিনের আলবদর রাজাকাররা তার দিকে জুতা ছুড়ে মারত। আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবকে উন্মত্ত হাসিতে জল্লাদ ইয়াহিয়া ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে সেখানে কবর দিত। লাশখানিও তার মাতৃভূমিতে পাঠাত না। কাদের সিদ্দিকীর সব মতামত ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি একমত নই। আমার সবকিছুর সঙ্গেও কেউ একমত হয় না। এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের নমুনা। কিন্তু কাদের সিদ্দিকীর আসন আমার হৃদয়ে এখনো গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে রেখেছি। শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের রক্তের সঙ্গে, বিশ্বাসঘাতকতা করলে তিনি অনেক আগেই মন্ত্রী হতে পারতেন। তিনি হননি।
পেশার তারে জড়ানো জীবনে বহু আগে তার বাবর রোডের বাড়িতে এক রাতে তার সঙ্গে খেয়েছিলাম। আলু ভর্তা, ছোট মাছ ও ডাল ছিল। অতি সাধারণ খাবার খেয়ে খুব তৃপ্তি পেয়েছিলাম। মুজিব হত্যার প্রতিবাদে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে যাওয়া কাদের সিদ্দিকীর প্রতি এই ভেবে মনে মনে আরেকবার শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলাম যে, জাতির জনকের হত্যার পর থেকে তিনি মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর কলামে একাত্তরে অবরুদ্ধ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সন্তানসম্ভবা হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে তার লেখা অংশটুকু আমার রুচিতে লেগেছে পাঠক হিসেবে। একজন লেখক লেখেন তার স্বাধীনতায়। গ্রহণ করা না করা পাঠকের ব্যাপার। আমি তা গ্রহণ করিনি। কিন্তু তিনি শাহবাগের জানাজা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন একজন মুমিন মুসলমানের সন্তান হিসেবেই হোক আর আল্লাহভীরু ও রাসূলের অনুসারী হওয়ার কারণেই হোক তার বক্তব্যের সঙ্গে একমত। জানাজা নামাজ ধর্মীয় ব্যাপার। এটা ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে ধর্মীয় নির্দেশিত পথেই আদায় করতে হয়। একজন মুসলমানের জন্য গোসল করার পরও নামাজের আগে অজু বাধ্যতামূলক।
শাহবাগে রাজীবের কফিন নিয়ে যদি শুধু প্রতিবাদ মিছিল হতো তাহলে কাদের সিদ্দিকী প্রশ্ন তুলতেন না। তুললে আমিও তার সঙ্গে একমত হতাম না। কিন্তু একজন মুসলমানের এই মৃত্যু শহীদি হলেও তার জানাজার দৃশ্য অনেককেই ব্যথিত করেছে। কাদের সিদ্দিকী সাহসী মানুষ বলে লিখেছেন। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা ব্যথিত হয়েছেন। আল্লাহভীরু ধর্মপ্রাণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লাখো লাখো রাজনৈতিক কর্মী বিতর্ক এড়াতে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেননি। যারা আস্তিক তারা জানাজা নামাজে পবিত্র হয়েই গেছেন। নাস্তিকরা দূরে থাকলেই পারতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানই নন, তিনি তা গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে তার স্বাধীন ভূমিতে ফিরে এসে অশ্রুসজল নয়নে দেওয়া বক্তৃতায় পরিষ্কার বলেছেন, 'আমি মুসলমান। মুসলমান বার বার মরে না, একবার মরে'। মওলানা ভাসানীর মতো প্রগতিশীল জনপ্রিয় বাম নেতার আগমন ঘটেনি এই মাটিতে। নামাজ ও ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকা মানুষটি মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রতিবাদী। সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে সমান নাগরিক অধিকারে বসবাস করার চেতনাই অসাম্প্রদায়িকতা। অসাম্প্রদায়িকতা বলতে বুঝি রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে না আনা।
সব ধর্মের মানুষের আত্দীয়তার বন্ধনে বাস করা। কাদের সিদ্দিকীর কলাম পড়ে সিলেটের যুগান্তরের ব্যুরো চিফ রেজওয়ান আহমেদের কাছ থেকে জেলা প্রশাসকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করলাম। ফোন করে নিজের পরিচয় দিতেই দেখলাম তিনি আমার প্রতিবেশী, পূর্ব পরিচিত। এক সময় ভোরের হাঁটাহাঁটিতে দেখা হতো। খান মোহাম্মদ বেলাল এখন সিলেটের ডিসি। একজন সজ্জন মানুষ। অমায়িক তার ব্যবহার। কাদের সিদ্দিকীর বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানালেন, এডিসি জেনারেল এটি পুরো জানেন। তবে যতটা বুঝলাম উপর মহলের ভয়ে কাদের সিদ্দিকীর বিষয়টি তারা এড়িয়ে গেছেন। উপরের নির্দেশ ছিল কিনা জানি না। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপের খানিক পরই একটা টেলিফোন এলো। পরিচিত কণ্ঠ। এনামুল হাবিব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের অনুজ ছিলেন। ভদ্র, বিনয়ী, মেধাবী এনামুলের ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। বাবা প্রফেসর হাবিবুর রহমান সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে সিলেটের হজরত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় স্যার প্রফেসর হাবিবুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ নির্লোভ, নীতিবান এক আদর্শ মানুষ ছিলেন।
প্রগতিশীল মুক্তচিন্তার এই মানুষটির সন্তান এনামুল হাবিব আমার অত্যন্ত প্রিয়জন। কিন্তু এনামুল হাবিব যখন কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন তখন আমার মনে খুব লেগেছে। লেগেছে মানে আঘাত লেগেছে। এনামুল হাবিব বললেন, কাদের সিদ্দিকী সার্কিট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন, যা তারা দিতে পারেন না। আমি জানতে চাইলাম তিনি থাকতে চেয়েছিলেন কিনা? এনামুল বললেন, থাকা ও সংবাদ সম্মেলন দুটো চেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে বললেন, কাদের সিদ্দিকীর বর্তমান অবস্থান ও কথাবার্তা সব মিলিয়েই তিনি দিতে পারেন না। আমি বললাম, কত অখ্যাতজন, কত রাজাকার এ দেশে মন্ত্রী-এমপি হয়ে সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে বিদায় হওয়ার আগে প্রেস ব্রিফিং করেন। কর্মী সভা করেন। তাকে বললাম কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম একাত্তর ও পঁচাত্তর ঘিরে যে ভূমিকা রেখেছেন শুধু তার জন্যই রাষ্ট্রীয় সব মেহমানখানা খুলে দেওয়া উচিত। এনামুল হাবিব বলে বসলেন, একাত্তর ও পঁচাত্তরের কাদের সিদ্দিকীকে তিনিও শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু পরবর্তী কাদের সিদ্দিকীকে শ্রদ্ধা করার নাকি কিছুই নেই। পরের কাদের সিদ্দিকী নাকি শুধু অন্ধকার। ফোনটা রেখে দিয়ে বুঝলাম আমার ভেতরে অস্থিরতা।
আমি কেমন করে স্নেহভাজন এনামুল হাবিবকে জড়িয়ে লিখব। এত ঘনিষ্ঠতার এত হৃদ্যতা তার শেষ কথায় সম্পর্কের বিচ্ছেদের চুক্তিনামায় যেন সই করাচ্ছে আজ। কাদের সিদ্দিকী অপমানের প্রতিবাদে যখন সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তার আগে আমাকে এলাকায় নিয়েছিলেন। তিনি তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানানোর আগে মা-হারা সন্তানের মতো দীর্ঘক্ষণ শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। তার জনতা সঙ্গে কেঁদেছিল। কাদের সিদ্দিকী তার দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পদত্যাগ করে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। সেদিন এই বীরের গণরায় ঠেকাতে গোটা সরকার ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও কাদের সিদ্দিকীর সম্পর্ক ভাই-বোনের। ভাই-বোনের সম্পর্ক বা ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক একবার ছিন্ন হলে যা দাঁড়ায় এখানে তা দাঁড়িয়েছিল বলেই কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রথম সম্মেলন শাসক দলের কর্মীরা গুলিবর্ষণের মুখে পণ্ড করেছিল। তবু কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটে যোগ দিয়ে মন্ত্রিত্ব নেননি। নিজের শক্তিতে লড়ে জয়ী হয়েছিলেন। একুশের গ্রেনেড হামলার পর ভারত থেকে ফিরেই সোজা যান সুধাসদনে তার বড় বোনকে দেখতে। আজকের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তাকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি বিএনপি নেত্রীর গলায় গামছা পরিয়ে দিয়ে ঐক্যের শর্ত দিয়েছিলেন।
যার অন্যতম জাতির শোকাবহ ১৫ আগস্টের রাতে জন্মদিনের কেক কাটা উৎসব না করা, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি বন্ধ করা, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা। তবু একা ছুটে চলার পরও এনামুল বলছেন কাদের সিদ্দিকীর সময় অন্ধকার! তরুণ প্রজন্ম, ব্লগার, স্লোগানকন্যারা সেদিন জন্ম নেননি। তারা জানেন না কীভাবে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকী জাতীয় মুক্তিবাহিনীর নামে কোরআন শরিফ ছুঁয়ে শপথ করা মুজিব-অন্তপ্রাণ প্রায় আট হাজার তরুণকে নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিলেন খেয়ে না খেয়ে। ১১৭ জন সেই যুদ্ধে শহীদ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় যে ইতিহাসকে অস্বীকার করা। সত্যকে আড়াল করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় জাতীয় বীরদের অনাদর-অবহেলা আর অপমানে তাদের জীবনকে অন্তহীন বেদনায় দগ্ধ করে জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ও লাখো শহীদের আত্দাকে কষ্ট দেওয়া। দিগন্ত টেলিভিশনে যাওয়া যদি পাপ হয় তাহলে আসিফ নজরুল তো সেখানে কখনো যাননি? আর কাদের সিদ্দিকী ছাড়া সরকারের অনুগত বা আস্থাভাজন কারা এ পর্যন্ত গেছেন তাদের তালিকা বের করুন। বিএনপি জমানায় লাইসেন্স পাওয়া টিভি চ্যানেলগুলোকে সেদিন নিউজ কভার করার অনুমতি দিতেন না বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা।
ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী সেসব টিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রচার হতে দেখা গেছে। তার পরও শাহবাগের গণজাগরণ থেকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা করে যুক্তি দিয়ে আবেগ দিয়ে যদি তারুণ্য প্রস্তাব দিত দিগন্ত টিভিতে না যাওয়ার, নিশ্চয়ই তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না তার সন্তানদের। শহীদজননী জাহানারা ইমাম টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলেন বলেই নন্দিত লেখক, শহীদের পুত্র মরহুম হুমায়ূন আহমেদ ইনকিলাবে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আমার প্রিয় মানুষ নির্বাচন কমিশনের সচিব কবি মোহম্মদ সাদিক। মাথায় হ্যাট, পরনে ফিদেল কাস্ত্রোর মতো পোশাক, রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসা বীরযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীর বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার বঙ্গবন্ধুর কাছে জমা দেওয়ার যে দৃশ্য কলেজপড়ুয়া সাদিকের মনে দাগ কেটেছিল তা নিয়ে '৯৪ সালে লেখা কবিতা 'কাদের সিদ্দিকীর টুপি'-তে প্রকাশ পায়। সংবাদে সেটি প্রথম প্রকাশ হয়। পরে এই নামে '৯৭ সালে তার কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়। সিলেট সার্কিট হাউসের ঘটনায় সেই কাব্যগ্রন্থের কথা বার বার মনে পড়ছে। দলকানা আমলার হৃদয় আর কবির হৃদয়ে কত পার্থক্য। আমলারা হন ক্ষমতার দাস। কবিরা হন সুফি-সাধক। কবির হৃদয়ে মানুষ বাস করেন বলেই সেখানে বীরত্বের প্রতীক হয়ে শোভা পান কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম।
আমলার দরজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় জাতীয় বীরের! শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে আশপাশে এমন কাউকে কাউকে দেখা যায় যারা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ বীরউত্তমদের দেখেন না, কাদের সিদ্দিকীর উচ্চতা দেখবেন কীভাবে? এখানে এক চোখে দেখলে হবে না। এখানে শাহবাগের জনসে াতে যেমন মানুষ যায় তেমনি আরাফাতের ময়দানে ধর্মপ্রাণ মুসলি্লদের লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক মিছিলে শরিক হয়। এখানে উৎসবমুখর দুর্গাপূজা হয়। পয়লা বৈশাখের রমনা বটমূলে নামে লাখো মানুষের জোয়ার। আবার তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমায় কিংবা জুমার নামাজে হজরত শাহজালালের মাজারের মসজিদে মুসলি্লদের ঢেউ খেলে যায়। এসব মিলিয়েই এক অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সবটাই আজ দেখতে হবে। দেখতে হবে একটি জাতি কীভাবে বিভক্ত রাজনীতির মাঝখানে মিরপুর জাতীয় স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপ ক্রিকেট ফাইনালে বাংলাদেশ হয়ে যায়। তাই উগ্রতা নয়। কোনো বিভেদ নয়। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়। সাইবার যুদ্ধে কারও চরিত্রহনন নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে যুক্তিতর্ক, বিতর্ক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাই শেষ কথা।
__._,_.___